নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র্যাবের ১১ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জয়পুরহাট ক্যাম্প থেকে ডেকে এনে রাজশাহী ব্যাটালিয়নে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এদিকে ঢাকায় আইনমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সুলতানার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাকারী এবং র্যাবের অভিযান ও জেরার সময় উপস্থিত থাকা যুগ্ম সচিব এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজশাহী র্যাবের উপ-অধিনায়ক মেজর হাসান মাহমুদ বলেন, ‘এ ঘটনায় আমাদের র্যাব সদস্যদের কোনো দোষ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র্যাব সদরদপ্তরের একটি উচ্চ পর্যায়ের দল বিভাগীয় তদন্ত করছে।’
গতকাল জয়পুরহাট ক্যাম্প থেকে তাঁদের রাজশাহীতে র্যাব-৫-এর ব্যাটালিয়ন সদর কার্যালয়ে ডাকা হয়। সেখানেই র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির সদস্যরা সুলতানাকে আটকের পরিস্থিতি এবং পরে তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওই ১১ জনের মধ্যে একজন মেজর, পুলিশের এএসপিসহ অন্যান্য সদস্য এবং গাড়িচালকও রয়েছেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সমকালকে বলেন, এ ঘটনা তদন্তে র্যাবের একটি দল রাজশাহীতে রয়েছে। তদন্তের প্রয়োজনে জয়পুরহাট থেকে ওই ১১ জনকে রাজশাহীতে ব্যাটালিয়ন দপ্তরে ডেকে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁরা আবার কর্মস্থলে ফিরে যাবেন।
সুলতানার মৃত্যুর ঘটনায় গত সোমবার তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে র্যাব সদরদপ্তর। আটক অভিযানে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা– তা খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটি। র্যাবও বলছে, গাফিলতির প্রমাণ পেলেই যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইনের অপব্যবহার হয়েছে– আইনমন্ত্রী : গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা ছিল না। পরে এ আইনে মামলা করা হয়েছে। এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, যেখানে দেখছি আমরা এ আইনের অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানে অপব্যবহার বন্ধ করার ব্যবস্থা নিচ্ছি। দু-একটা ঘটনায় অপব্যবহার হচ্ছে; ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘থানায় মামলা হওয়ার পরই আসামিকে আটক করার নিয়ম। কিন্তু সুলতানা জেসমিনকে যখন র্যাব আটক করে, তখন তাঁর নামে কোনো মামলা ছিল না। তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। মামলা হওয়ার আগেই তাঁকে আটক করা উচিত হয়নি।’
তদন্তের মুখে যুগ্ম সচিবও : র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগের মুখে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশন অফিসের পরিচালক (স্থানীয় সরকার) যুগ্ম সচিব এনামুল হক। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতেই সুলতানা জেসমিনকে আটক করেছিল র্যাব। কিন্তু ওই নারীকে আটকের সময় যুগ্ম সচিবের উপস্থিত থাকার অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দাপ্তরিক অনুমতি ছাড়া যুগ্ম সচিবের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে এ ঘটনায় তিনিও ফাঁসবেন।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, আমরা বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়েছি। এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে প্রয়োজন মনে করলে তদন্ত কমিটি গঠন করব। নওগাঁ থেকে ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট পেয়েছি। এনামুল হক যেহেতু রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কর্মরত, সে জন্য ওই অফিস থেকে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যুগ্ম সচিব এনামুল হক কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব জানান, সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে তদন্ত প্রতিবেদনের পর। তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা তদন্ত প্রতিবেদনের পর জানা যাবে।
এদিকে, যুগ্ম সচিব এনামুল হক নিজেই সমকালের কাছে স্বীকার করেছেন এবং মামলার এজাহারেও উল্লেখ করেছেন, তাঁর উপস্থিতিতেই গত ২২ মার্চ র্যাব সুলতানাকে আটক করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ বিষয়ে জানতে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরুল্লাহকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
র্যাব হেফাজতে ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় যুগ্ম সচিব দায় এড়াতে পারেন না বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসনের অপর একটি সূত্র। তবে এ ক্ষেত্রে বড় দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। যুগ্ম সচিব হোন আর সচিব– অভিযোগকারী তাঁর সমস্যার কথা বলবেন; কিন্তু এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ কী হবে, সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন অনুসরণ করেই সম্পন্ন করবে। সূত্রটি আরও জানায়, র্যাবের অভিযানে অনুমতি ছাড়াই যুগ্ম সচিব উপস্থিত ছিলেন বলে প্রমাণ হওয়ামাত্রই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হবে।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন অনু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, যুগ্ম সচিবের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে প্রতারণা করা হচ্ছিল। প্রাথমিকভাবে এর সত্যতা মিলেছে। কিন্তু আটক হওয়া নারীর মৃত্যুর পর মামলা দায়ের হয়েছে কিনা, যুগ্ম সচিব অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন কিনা– এসব বিষয় পর্যালোচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদি যুগ্ম সচিবের দোষ থাকে, অবশ্যই তাঁকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। ২২ মার্চ সকালে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে তাঁকে আটক করে র্যাব। আটক অবস্থায় সুলতানাকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে র্যাব পাহারায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ২৪ মার্চ তিনি মারা যান। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের পরিচালক (স্থানীয় সরকার) মো. এনামুল হক গত ২৩ মার্চ সুলতানার বিরুদ্ধে রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করেন।
সুলতানার পরিবারের সদস্যরা তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন।
Leave a Reply